বনানীর বহুতল ভবনে আগুন। প্রাণ বাঁচাতে লাফ। উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস। স্বজনদের আহাজারি
Ns News Online Desk: বাংলাদেশের রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে ভয়ংকর আগুনে পুড়েছে ২২ তলা বহুতল ভবন । বেলা পৌনে ১টার দিকে লাগা টানা ছয় ঘণ্টার দানবরূপী আগুন কেড়ে নিয়েছে একজন শ্রীলঙ্কান নাগরিকসহ ২৫ জনের প্রাণ। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা এমন শতাধিক ব্যক্তিকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন সেনা, নৌ, বিমান এবং ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা। উদ্ধার হওয়া অন্তত ৭০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ইউনাইটেড ও অ্যাপোলোসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্যদিকে আগুন লাগা ভবনে আটকে পড়া ব্যক্তি এবং তাদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছিল ভবনের আশপাশ। নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে তাদের স্বজনেরা ভিড় করেছেন রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয়ংকর এই আগুনের উদ্ধার তৎপরতা তদারক করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন । এরই মধ্যে আগুনের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন।
আগুন লাগার পরপরই বেলা ১টার দিকে সরেজমিনে আতাতুর্ক এভিনিউয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনে ও পেছনে অগণিত উৎসুক জনতার ভিড়। আটকা পড়েছেন এমন অনেকের স্বজনেরা এরই মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। ভবনের বিভিন্ন তলার জানালা দিয়ে হাত বের করে তাদের উদ্ধার করার করুণ আকুতি জানাতে দেখা যায় আটকে পড়া ব্যক্তিদের। ক্রমেই বেড়েছে আগুন। অসহায় মানুষের উদ্বেগ-আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছিল সেখানকার পরিবেশ। এরই মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি-সংবলিত তাদের যৌথ উদ্ধার অভিযানে প্রাণান্তকর সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ক্রমেই বেড়েছে আগুনের ভয়াবহতা। তবে অগণিত উৎসুক জনতার কারণে উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। বারবার মাইকিং করে তাদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করা হলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। এর মধ্যেই পার্শ্ববর্তী ভবন থেকে দড়ি বেয়ে অনেককে নামতে দেখা গেছে। তখনই দুর্ভাগা এক তরুণ ও এক তরুণীকে ফসকে পড়ে যেতে দেখা যায়।
জানা গেল, ২২ তলা ওই ভবনে আমরাই নেটওয়ার্ক, কাশেম গ্রুপ, মাইকা গ্রুপ, ডার্ট গ্রুপসহ অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। রয়েছে কনভেনশন হল, রেষ্টুরেন্ট। বেলা পৌনে ২টার দিকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার এফআর টাওয়ারসহ আশপাশের ভবনের ছাদে আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে আসে। পানির ঘাটতি দেখা গেলে হেলিকপ্টার দিয়ে আগুন লাগা ভবনে পানি ছাড়েন বিমানবাহিনীর সদস্যরা।
ঘটনার ভয়াবহতা জানতে পেরে সেখানে ছুটে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, স্থানীয় এমপি আকবর হোসেন পাঠান ফারুক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ, ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর প্রমুখ।
বেলা পৌনে ২টার দিকে এফআর টাওয়ারের অষ্টম তলা থেকে একজন হতভাগ্য তরুণীকে ভাঙা কাচের ফাঁক দিয়ে নিচে পড়তে দেখা যায়। গুরুতর আহত ওই তরুণীর গোটা শরীরে কাচের টুকরা বিদ্ধ হয়ে ছিল। উদ্ধারকর্মী আকরাম হোসেন জানান, আটতলা থেকে একটি মেয়ে তার ধরে ধরে নামার চেষ্টা করছিলেন। তখন হাত ফসকে মাটিতে পড়ে যান। এর পরপর আরও দুইজন পুরুষ পড়ে যান। তিনি নিজে এই তিনজনকে সেখান থেকে উদ্ধার করেছেন। মেয়েটার পুরো শরীরে কাচ লেগে ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (উন্নয়ন) কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান বলেন, ‘ফায়ারের ২২টি ইউনিটসহ বিমান, সেনা, নৌবাহিনীর অন্তত আরও ১০টি ইউনিট আগুন নেভানো এবং উদ্ধারকাজে অংশ নেয়। ২২ তলা ভবনের সব তলায়ই আমাদের কর্মীরা যাচ্ছেন। কেউ আটকা পড়ে থাকলে বা হতাহত হয়ে থাকলে তাদের উদ্ধার করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছেন। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাজ করেছি। এ ছাড়া এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিগগিরই জানা যাবে কোথা থেকে আগুন লেগেছিল।’
আইএসপিআরের পরিচালক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ বলেন, বনানীর আগুন নেভাতে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার কাজ করছে। সেনাবাহিনী সরাসরি উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে। বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। বিমানবাহিনীর তিনটি হেলিকপ্টার আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল ইসলাম খান জানান, ওই ভবনে আগুনের ঘটনায় আহত পাঁচজনকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছে।
উদ্ধার অভিযান তদারক করেন প্রধানমন্ত্রী : আগুন লাগা ও ভবনটিতে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে চলা অভিযান সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগুন নিয়ন্ত্রণ ও হতাহতদের পাশে দাঁড়াতে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটর করছেন।
ভাঙা কাচ দিয়ে হাত বের করে বাঁচার আকুতি : যে তলায় আগুন লেগেছে, তার ওপরের তলাগুলোয় অনেকেই আটকা পড়েন। আটতলায় আগুনের উৎপত্তির পরপরই অনেকে আতঙ্কে ওপরের তলাগুলোয় আশ্রয় নেন। কেউ কেউ ছাদে উঠে পাশের ভবনে গিয়ে নামার চেষ্টা করেন। কয়েকজন বিভিন্ন ধরনের তার ধরে নামার চেষ্টা করেন। আর যারা ভবনটির ভেতর আটকা পড়েছেন, তাদের ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে হাত বের করে সাহায্য চাইতে দেখা যায়।
সেঁজুতি স্বর্ণা নামের একটি ফেসবুক ওয়াল থেকে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায়, একজন বলছেন, ‘আমাদের জন্য সিঁড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তা না হলে ধোঁয়ায় আমরা মারা যাব।’ আরেকটি ভিডিওতে তিনি জানালা দিয়ে নিচের রাস্তা দেখিয়ে বলছেন, ‘আমরা ভেতরে আটকা।’
কুর্মিটোলা হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রফিকুননবী জানান, অন্তত ৩০ জনকে ওই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে নিরাস চন্দ্র নামের এক শ্রীলঙ্কান নাগরিককে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন। মৃত অবস্থায় তাকে হাসপাতাল আনা হয়। যাদের কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে গুরুতর দগ্ধ কেউ নেই। অধিকাংশই ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অথবা লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন বলে জানান পরিচালক।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক জানান, আগুনের ঘটনায় প্রাণহানির শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনের মৃতদেহ আছে ইউনাইটেড হাসপাতালে। আরও ২৩ জনকে আহত বা অসুস্থ অবস্থায় সেখানে ভর্তি করা হয়েছে।
অনন্য দৃষ্টান্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের : অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধারকাজে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আশপাশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার খবরে ঘটনাস্থলে ছুটে যান তারা। এরপর সেখানে স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব পালন করেন। আগুন লাগা ভবনটিতে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে এগিয়ে আসা শিক্ষার্থীর মধ্যে ছিলেন প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি), সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়, ফারইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা।